আমার বৈজ্ঞানিক হওয়ার পিছনে বাংলায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান বা পপুলার সায়েন্স বইগুলির অবদান অনেকখানি। ছোটবেলায় অদৃশ বর্ধন, শ্যামল চক্রবর্তী, কিয়দংশে পথিক গুহ, ও বিশেষ করে নারায়ণ সান্যালের বহু লেখা আমাকে বৈজ্ঞানিক হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। এনাদের লেখা অসংখ্য বইয়ের মধ্যে নারায়ণ সান্যালের লেখা “বিশ্বাসঘাতক” বইটি আমার বিশেষ প্রিয়। আমি এটি প্রথম পড়ি ক্লাস নাইনে। আমার বাংলা শিক্ষক কৃষ্ণাদির ( কৃষ্ণা হাজরা ) সুপারিশে আমার বাবা কিনে দিয়েছিল এই বইটি। মনে আছে, হাতে পাওয়া মাত্রই গোগ্রাসে পড়ে ফেলেছিলাম। প্রথম পড়ার সময় অনেককিছুই বুঝতে পারিনি। তবে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, তেজস্ক্রিয়তা, পরমাণু ভাঙ্গা, ও পারমাণবিক বোমা বানানোর গল্পগুলি মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম যে আমাকেও একদিন বিজ্ঞানী হতে হবে।
ভাগ্যক্রমে আমি বর্তমানে লস আলামোস ( Los Alamos ) বলে একটি শহরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করি। সেই লস আলামোস, যেখানে খুব গোপনে ম্যানহাটান প্রোজেক্টের মাধ্যমে শত শত বিজ্ঞানী পারমাণবিক বোমা তৈরি করেন। সেই লস আলামোস, যার পটভূমিকায় বিশ্বাসঘাতকের এক বড় অংশ লেখা হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে সেই সময়কার (১৯৪৩-৪৫) অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। সেখানে যেমন অজানা অনেক তথ্য পাওয়া যায়, তেমনি মাঝে মাঝে কিছু কিছু জিনিস দেখে বিশ্বাসঘাতকের কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয়, “আরে, বিশ্বাসঘাতকে এটা পড়েছিলাম না!” তাই, অনেকদিন ধরেই মনে হচ্ছিল বিশ্বাসঘাতকের পটভূমিকায় লস আলামোস কে নিয়ে একটা ভ্রমণকাহিনী গোছের লেখা লিখি। সেই ভাবনাকে রূপ দিতেই আজকের এই লেখা।
প্রথমে আসি ওপেনহাইমার ও লেসলি গ্রোভস-এর কথায়। লেসলি গ্রোভস ছিলেন ম্যানহাটান প্রোজেক্টের সামরিক কর্তা ও ওপেনহাইমার ছিলেন তাঁর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। লস আলামোসের আইডিয়াটা ওপেনহাইমারেরই। বিশ্বাসঘাতক থেকে একটু অংশ তুলে দিচ্ছিঃ
“গ্রোভস খুশী হলেন। অত্যন্ত খুশী হলেন। … সম্ভাব্য স্থানগুলির তালিকা দেখে ওপেনহাইমার বললে, আমি নিশ্চিত- আপনি লস অ্যালামসকেই নির্বাচন করবেন।”
প্রসঙ্গত বলে রাখি, যদিও নারায়ণ সান্যাল শহরটির নাম লস অ্যালামস বলে বাংলায় তর্জমা করেছেন, এর প্রকৃত স্প্যানিশ উচ্চারণ হল লস আলামোস। Alamo শব্দের মানে হল পপলার গাছ, বিশেষ করে আমেরিকার এই দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে Cottonwood বলে একটি গাছের স্প্যানিশ নাম হল আলামো। এই গাছ এখানে প্রচুর, তাই হয়ত এই জায়গার নাম লস আলামোস হয়েছে। যাইহোক, লস আলামোস শহরের মধ্যিখানে ওপি (ওপেনহাইমারের ডাকনাম) ও গ্রোভসের একটি মূর্তি আছে, যার ছবি আমি নীচে দিলাম।
এই মূর্তিটি অবস্থিত ফুলার লজ বলে একটি বাড়ির সামনে। আসলে এটি একসময় লস আলামোস র্যাঞ্চ স্কুলের খাবার ঘর ছিল। ওপি এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন, তাই তিনি লস আলামোস ও তার নিকটবর্তী জায়গাগুলির দুর্গমতা ও জনমানবহীনতার ব্যাপারে অবগত ছিলেন। তাই ম্যানহাটান প্রোজেক্টের মত চরম গোপনীয় কাজের পক্ষে লস আলামোস আদর্শ জায়গা ছিল। এমনকি এই স্কুলটি ছাড়া আর কোন বাড়িঘরও এই শহরে তখন ছিল না [১]। তাই, ফুলার লজ ও স্কুলের অন্যান্য বিল্ডিংগুলোকেই প্রাথমিক ভাবে ম্যানহাটান প্রোজেক্টের নানা কাজে ব্যাবহার করা হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতকের বর্ণনাটি খুবই সুন্দরঃ
“নিউ-মেক্সিকোর এক জনমানবহীন প্রান্তরে অন্তেবাসী জনপদ সান্তা-ফে। সেখানে থেকে একটা উদাসী সড়ক চলে গেছে পাহাড়ের উপর। ঐ পাকদণ্ডী পথের প্রান্তে আছে একটা ছোট্ট স্কুল। … সমুদ্র সমতল থেকে সাত-হাজার ফুট উপরে ভারি সুন্দর পরিবেশে এই স্কুলটি অবস্থিত।”
জায়গার মত স্কুলটিও যে খুব সুন্দর তা ছবি দেখেই বুঝতে পারবেন।
এই স্কুলটিকে ঘিরেই লস আলামোস শহরটি গড়ে উঠেছিল। তাই এই স্কুলের আসে-পাশে অনেক বিজ্ঞানীর বাড়ি-ঘরও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যেমন থিওরেটিকাল বিভাগের প্রথম ডিরেক্টর হান্স বেথের বাড়িটি খুব সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত। এই বাড়িটি অবশ্য ম্যানহাটান প্রোজেক্টের সমকালীন নয়, পরে বানানো।
ফুলার লজের সংলগ্ন আউটহাউস-টি অবশ্য ম্যানহাটান প্রোজেক্টের সময়েরই। তখন বাড়ি-ঘরের এতই অভাব ছিল যে এক্সপ্লোসিভ বিভাগের ডিরেক্টর জর্জ কিস্টিয়াকৌস্কি বা কিস্টি থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন ঐ দশ ফুট বাই দশ ফুটের আউটহাউসেই।
স্থানাভাবের দৌলতে তখনকার অনেক বাড়িই আর অবশিষ্ট নেই। অবক্ষয় ঠেকাতে তখনকার পোস্ট-অফিসটিরও আধুনিকীকরণ করা হয়েছে।
ম্যানহাটান প্রোজেক্টের স্মৃতি লস আলামোসের শিরায় শিরায়। তাই স্মৃতিস্তম্ভ না থাকলেও বিশ্বাসঘাতকের জমানার স্বাদ পেতে খুব কষ্ট হয়না।
~~~~~~~~~~~~~ ooo ~~~~~~~~~~~~~
[১] এটা বলা ভুল হবে যে লস আলামোসে আর কোন বাড়ি ছিল না। লস আলামোস ও সংলগ্ন এলাকায় বহুকাল ধরে আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা ( নেটিভ আমেরিকানরা ) থাকতেন। তবে ম্যানহাটান প্রোজেক্টের অনেক আগেই তাঁরা লস আলামোস ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন। ফুলার লজের কাছে তাদের পুয়েব্লো স্টাইলের বাড়ি ঘরের ধ্বংসাবশেষও দেখা যায়। লস আলামোস থেকে কয়েক মাইল দূরত্বের মধ্যে এই আদিম অধিবাসীদের অনেক উপজাতি বসবাস করেন। তাঁদের জীবনযাপনের পদ্ধতি পুরোপুরি আধুনিক, তবে এখান থেকে প্রায় ৭০-৮০ মাইল দূরে টাওস বলে এক জায়গায় এক বিশেষ উপজাতির নেটিভ আমেরিকানরা এখনো পুয়েব্লো স্টাইলের গ্রামে থাকেন। ভাবতে অবাক লাগে, তাঁরা এই গ্রামে গত হাজার বছর ধরে রয়েছেন!